বর্তমানে মানুষের আচার-আচরণে লৌকিকতা ব্যাপকত্ব লাভ করেছে। সীমাহীন ভণিতা ও কৃত্রিমতার মধ্যে যেন সত্যপ্রকৃত বাস্তবতা হারিয়ে যাচ্ছেআনুষ্ঠানিকতার ভিড়ে যেন মূল কাজ থেকেই মানুষ দূরে সরে যাচ্ছেকৃত্রিম হয়ে উঠেছে মানুষের নীতি-নৈতিকতামূল্যবোধ

অথচ ইসলামে এজাতীয় কৃত্রিমতার স্থান নেইরাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সব আচরণই সমগ্র মানবতার জন্য আদর্শআর বিনয়অকৃত্রিম আচরণ ছিল তাঁর অনুপম আদর্শের প্রতীকমহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, আর আমি কৃত্রিমতা অবলম্বনকারীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৮৬)

লৌকিকতা পরিহারে নবীজির নির্দেশনা

সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, আমরা একদা উমর (রা.)-এর কাছে ছিলামতখন তিনি বলেছিলেন, আমাদের কৃত্রিম ব্যবহারলৌকিকতা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭২৯৩)

আসমা বিনতে ইয়াজিদ (রা.) বলেন, একবার নবী (সা.)-এর সামনে খানা পরিবেশন করা হলো, তখন তিনি আমাদেরও খানায় শরিক হতে আহবান করলেনতদুত্তরে আমরা বললাম, না, আমাদের চাহিদা নেই

তখন নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা (লৌকিকতাবশত) ক্ষুধা ও মিথ্যাকে একত্রিত কোরো না।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩২৯৮)

অর্থাৎ তোমাদের খাবারের প্রতি আহবান করা হলে ক্ষুধা থাকলে তোমরা দস্তরখানে শরিক হয়ে যাবে, এতে কৃত্রিম লজ্জাবশত ‘চাহিদা নেই’ বলে মিথ্যার আশ্রয় নেবে না। এই হাদিসে কৃত্রিমতা পরিহার করে সাধারণ ও সরল আচরণ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অকৃত্রিম আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত

আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন : কখনো কখনো এমন হতো যে মদিনার কোনো নিম্নস্তরের বাঁদী এসেও (তার কোনো কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে হাত ধরে টেনে নিয়ে তার ইচ্ছামতো এখানে-সেখানে নিয়ে যেত। (বুখারি, হাদিস : ৬০৭২)

মানুষের দুনিয়াবি বিভিন্ন প্রয়োজনেও সহযোগিতার জন্য যেকোনো সময় নবীজি (সা.)-কে তারা অকৃত্রিমভাবে কাছে পেত।

তাঁর নবুয়তির মহান দায়িত্ব পালন এসব কাজের জন্য প্রতিবন্ধক হতো না। দোজাহানের সরদার হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের আব্দার ও মন রক্ষা করতেন। এটি তাঁর সীমাহীন বিনয় ও অকৃত্রিম আচার-আচরণের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।

খারেজা ইবনে জায়েদ (রহ.) বর্ণনা করেন, একদা কিছু লোক জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.)-এর কাছে এসে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিষয়ে কিছু বলতে আরজ করল। জায়েদ ইবনে সাবেত (রা.) বললেন, তাঁর সম্পর্কে কী বলব? আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিবেশী ছিলাম, যখন কোনো অহি নাজিল হতো তিনি আমাকে খবর পাঠাতেন তা লেখার জন্য। আর (তিনি তো এমন ছিলেন!) যখন তাঁর সঙ্গে আমরা আখিরাতের আলোচনা করতাম তিনি আমাদের সঙ্গে আখিরাতের আলোচনা করতেন, আর যখন আমরা দুনিয়াবি আলোচনা করতাম তিনিও আমাদের সঙ্গে দুনিয়ার আলোচনা করতেন।... (আলমুজামুল কাবিরতাবারানি, হাদিস : ৪৮৮২)

এতে প্রমাণিত হয়, তিনি আর ১০ জন সাধারণ মানুষের মতোই মানুষের সঙ্গে দুনিয়াবি বৈধ আলোচনায় তাঁর নবুয়তের গাম্ভীর্য নষ্ট হবে বলে মনে করতেন না।

আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ (রহ.) বলেন, আমি নবীপত্নী আয়েশা সিদ্দিকা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম : রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘরে কী করেন? তিনি বললেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পরিবারের গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করেন, যখন আজান শোনেন তখন নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যান।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৩৬৩)

কী অনুপম আদর্শ! সমগ্র জাহানের হেদায়েতের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন মহান নবী তাঁর পরিবারের সঙ্গে কী অকৃত্রিম আচরণ করতেন এবং তাঁদেরকে উপযোগী সময় দিতেনএতে তাঁর নবুয়তের মহান মানমর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করতেন না

আবু বকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত হিজরতের ঘটনার বর্ণনায় এসেছে। নবীজি (সা.) যখন মদিনা শরিফে পৌঁছলেন, তখন চুপচাপ বসা ছিলেন। অনেকে তাঁকে (পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণের স্বাভাবিকতার কারণে) চিনতে পারেনি, বরং আবু বকর (রা.)-কে সালাম দিচ্ছিল। সূর্যের তাপে যখন নবীজি (সা.) কষ্ট পাচ্ছিলেন, তখন আবু বকর (রা.) নিজের চাদর দিয়ে তাঁকে ছায়া দিলেন। তখন সবাই বুঝলইনিই হলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)। (বুখারি, হাদিস : ৩৯০৬)

এই ছিল নবীজি (সা.)-এর সাদামাটা জীবনের সামান্য একটি ঝলক। হাদিস, সিরাত ও ইতিহাসের কিতাবাদিতে অনুরূপ অসংখ্য ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে অকৃত্রিম আচার-আচরণে নবীজি (সা.)-এর নবুয়তি মানমর্যাদা ও গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ন হতো বলে মনে করতেন না। আর আজ আমাদের লৌকিকতার ভিড়ে আসল-নকল চেনাও দায় হয়েছে। নবীজি (সা.)-এর এসব ঘটনা আমাদের সাদামাটা ও অকৃত্রিম জীবনাচারের প্রতি উৎসাহিত করে।