অপরাধ বৃদ্ধির সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ

বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইনশৃঙ্খলার শূন্যতার পাশাপাশি কিছু গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এসব কারণ বহু বছর ধরে জমে থাকা সমস্যা, যা সময়ের সঙ্গে আরও জটিল হয়ে উঠেছে।


১. বেকারত্ব ও দারিদ্র্য

বাংলাদেশে ১৮–৩৫ বছর বয়সী তরুণদের একটি বিশাল অংশ এখনো কর্মহীন বা অস্থায়ী পেশায় যুক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের বেকারত্বের হার ছিল প্রায় ৫.৭%, তবে গ্রামাঞ্চলে ও নিম্নশিক্ষিত শ্রেণিতে এটি অনেক বেশি।


ফলাফল:


অপরাধে সম্পৃক্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি


মাদক ব্যবসায় তরুণদের জড়িয়ে পড়া


অল্প আয়ে অতৃপ্ত জীবনের ফলে চুরি, ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়ানো


২. সামাজিক বৈষম্য

একদিকে দেশের একটি শ্রেণি যেখানে বিলাসী জীবনযাপন করছে, অন্যদিকে বৃহৎ জনগোষ্ঠী দিন কাটায় অনিশ্চয়তায়। এই বৈষম্য থেকে জন্ম নিচ্ছে সামাজিক ক্ষোভ ও সহিংসতা।


প্রভাব:


নিম্নবিত্ত তরুণদের মধ্যে হিংসা ও অপরাধপ্রবণতা


সমাজের প্রতি আস্থা হারিয়ে অপরাধকে বিকল্প পথ হিসেবে বেছে নেওয়া


৩. পারিবারিক অবক্ষয়

বর্তমানে অনেক পরিবারে বাবা-মায়ের ব্যস্ততা, একক পরিবারের বেড়ে চলা, এবং সন্তানদের প্রতি পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে তারা সহজেই গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে।


উদাহরণ:


অনেক কিশোর গ্যাং সদস্য জানায়, তারা “পরিবারের ভালোবাসা বা সহানুভূতি পায় না”।


বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বর্তমানে বহু সমস্যায় জর্জরিত। দ্রুত বিচার, সঠিক তদন্ত এবং আইনগত শাস্তি প্রদান না হওয়ার ফলে অপরাধীরা উৎসাহ পায়।


১. মামলার দীর্ঘসূত্রতা

একটি মামলার নিষ্পত্তি হতে গড়ে ৫–১০ বছর সময় লাগে


জামিনের অপব্যবহার করে অপরাধীরা ফের অপরাধে জড়ায়


সাক্ষীর নিরাপত্তা না থাকায় অনেকেই সাক্ষ্য দিতে অনিচ্ছুক


২. তদন্তের দুর্বলতা

অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা


ফরেনসিক প্রযুক্তির অভাব


রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পক্ষপাতমূলক তদন্ত


৩. বিচারিক দুর্নীতি

মামলার ফলাফল “ঘুষ” বা “প্রভাবশালী মহলের চাপ” দ্বারা প্রভাবিত হয়


আইনজীবী ও বিচারক মহলে স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে


মাদক ও চোরাচালান

মাদক বাংলাদেশে অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালক হয়ে উঠেছে। যুব সমাজের একটা বড় অংশ ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা ও আইস-এর মতো মাদকে আসক্ত।


চিত্র:

কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ অব্যাহত


রাজধানীর বস্তি এলাকাগুলোতে মাদক বিক্রির হাট


শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকের প্রভাব আশঙ্কাজনক


পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযান সত্ত্বেও:

বড় মাদক চক্র রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে


অনেক সময় দেখা যায়, অভিযানের পরদিনই আবার বিক্রি শুরু হয়


প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধ (সাইবার ক্রাইম)

বর্তমান ডিজিটাল যুগে অপরাধীরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নতুন ধরনের অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।


উদাহরণ:

মোবাইল ব্যাংকিং জালিয়াতি


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল


নারীদের ছবি দিয়ে ‘মরাল পলিসিং’ বা কনটেন্ট ছড়িয়ে হুমকি


চাকরির প্রলোভনে ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়া


সমস্যা:

সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দক্ষ পুলিশ সদস্যের ঘাটতি


অনেক সময় ভুক্তভোগীরা লজ্জার ভয়ে অভিযোগ করেন না


সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার

বাংলাদেশে অপরাধ ও প্রশাসনিক দুর্বলতা নিয়ে কথা বললেই অনেকে পড়ছেন হয়রানির শিকার।


২০২৫ সালের জানুয়ারি–মে:

৯১ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে হামলা, হুমকি, মামলা বা অফিসে আগুন দেওয়ার শিকার


“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” ব্যবহার করে সমালোচকদের দমন


এতে সংবাদমাধ্যমে সত্য প্রতিবেদন করার সাহস হারিয়ে যাচ্ছে, ফলে অপরাধের প্রকৃত চিত্র অনেক সময় চাপা পড়ে থাকে।


নাগরিক সমাজের উদ্যোগ

যদিও সরকার ও প্রশাসন অনেক সময় ব্যর্থ, তবু দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ নিচ্ছে:


কিছু ইতিবাচক উদাহরণ:

নারায়ণগঞ্জের একটি মহল্লায় “কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম” গঠন করে মাদক নির্মূল কার্যক্রম শুরু


খুলনায় গৃহিণীদের নেতৃত্বে “সচেতন মা পরিষদ” গঠন করে কিশোর গ্যাং দমনে ভূমিকা


ঢাকার মোহাম্মদপুরে “পাড়াভিত্তিক নজরদারি দল” গঠন


সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ

বাংলাদেশের বর্তমান অপরাধ পরিস্থিতি শুধুমাত্র প্রশাসনিক ইস্যু নয়—এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক সংকট। তাই এর সমাধানও হতে হবে বহুমুখী।


প্রশাসনিক ও আইনগত:

পুলিশের স্বাধীনতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করা


ফরেনসিক ও তদন্ত দক্ষতা বৃদ্ধি


দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের সম্প্রসারণ


সামাজিক:

পরিবারে সন্তানদের মনোযোগ দেওয়া ও পারিবারিক বন্ধন জোরদার


স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিং, কিশোর মনোবিজ্ঞান শিক্ষা


ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সমাজকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা


অর্থনৈতিক:

তরুণদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ


উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল


শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি


প্রযুক্তিগত:

সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট শক্তিশালী করা


মোবাইল ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বাড়ানো


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মনিটরিং ইউনিট


উপসংহার

বাংলাদেশে অপরাধ একটি বহুমাত্রিক সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একা এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, যদি না সামাজিক সচেতনতা, বিচারিক সংস্কার, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা একত্রে কাজ করে।


বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন:


কার্যকর নীতি


রাজনৈতিক পক্ষপাতমুক্ত প্রশাসন


জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ


অন্যথায় এই অপরাধচক্র সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়বে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক অনিশ্চিত বাংলাদেশ রেখে যাবে।