ভূমিকা
বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। রাজনৈতিক রদবদল, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অকার্যকারিতা এবং সামাজিক অসন্তোষ একসাথে মিলে দেশের অপরাধ পরিস্থিতিকে জটিল এবং উদ্বেগজনক করে তুলেছে। যদিও কিছু সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে সামগ্রিক অপরাধ কমেছে, বাস্তব পরিস্থিতি বলছে উল্টো কথা—হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ও নারী-শিশু নির্যাতনের হার ক্রমেই বাড়ছে।
এই প্রবন্ধে আমরা বর্তমান অপরাধ পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করবো, এর পেছনের কারণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব, এবং সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো।
সামগ্রিক চিত্র
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশের বিভিন্ন থানায় মোট ১,৭২,০০৫টি অপরাধ রেকর্ড করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে, ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১,৯৫,৪৩৬। এতে মনে হতে পারে যে অপরাধ কমেছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সহিংস অপরাধের সংখ্যা, বিশেষত হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ও ডাকাতি, গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসেই:
হত্যা: ২৯৪ (২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল ২৩১)
ছিনতাই: ২৪২টি ঘটনা, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ
অপহরণ: দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি
নারী ও শিশু নির্যাতন: ১০৪৩টি অভিযোগ, যা ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে সামান্য কম হলেও এখনও উদ্বেগজনকভাবে বেশি
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অপরাধ বৃদ্ধি
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের (নেতৃত্বে: ড. মুহাম্মদ ইউনুস) অভ্যুদয়ের পর থেকেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠনের মধ্যবর্তী সময়ে অনেক পুলিশ স্টেশন আক্রমণের শিকার হয় এবং কয়েকশো পুলিশ অফিসার এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এমন পরিস্থিতিতে অপরাধী চক্রগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বিশেষ করে রাজনৈতিক শূন্যতার ফলে:
জেল থেকে পালিয়ে যায় ২২০০-এর বেশি আসামি, যার মধ্যে অনেক কুখ্যাত সন্ত্রাসীও ছিল
অনেক এলাকায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় কিশোর গ্যাং ও স্থানীয় মাস্তানদের দখলে চলে যায়
শহর বনাম গ্রাম: অপরাধের ভিন্নতা
শহরাঞ্চল:
ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের মতো শহরগুলোতে ছিনতাই, কিশোর গ্যাং, মাদক ব্যবসা এবং নারী নির্যাতন সবচেয়ে বেশি ঘটে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় (যেমন গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা) রাতের বেলা চলাফেরা করা বেশ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
গ্রামাঞ্চল:
গ্রামাঞ্চলে অপরাধের ধরণ একটু আলাদা। এখানে জমি দখল, গ্রাম্য শত্রুতা, পারিবারিক কলহ থেকে হত্যার ঘটনা বেশি দেখা যায়। এছাড়াও চাঁদাবাজি ও মাদক পাচার বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিশোর গ্যাং ও তরুণ অপরাধ
ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ৫০টির মতো সক্রিয় কিশোর গ্যাং আছে বলে পুলিশ ধারণা করে। এদের মধ্যে অনেকেই স্কুল-কলেজে পড়ুয়া, কিন্তু নিয়মিত জড়িয়ে পড়ছে:
অস্ত্র বহন
এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার
মাদক বিক্রি ও সেবন
সংঘর্ষে অংশগ্রহণ
২০২৪ সালের প্রথমার্ধে কেবল ঢাকায় প্রায় ৬০০ কিশোর গ্যাং সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।
কারণসমূহ:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাং কালচারের প্রসার
অভিভাবকের অবহেলা
পড়াশোনার প্রতি অনীহা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলার অভাব
নারী ও শিশু নির্যাতন
নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সামাজিক সমস্যাগুলোর একটি। প্রতি মাসে গড়ে ১২০০+ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়।
আলোচিত ঘটনা:
২০২৫ সালের মার্চ মাসে মাগুরায় ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা করে মূল অভিযুক্ত। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
সামাজিক আন্দোলনের ফলে ওই ঘটনার বিচার ত্বরান্বিত হয়, কিন্তু একই ধরনের হাজারো অভিযোগ এখনো বিচারাধীন।
গভীর সমস্যা:
অধিকাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করে না
প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে মামলা প্রত্যাহার
তদন্তে গাফিলতি ও সময়ক্ষেপণ
বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা
সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ বাহিনী সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতার শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও ১০০০+ মানুষ নিহত হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ পুলিশের প্রতি অসন্তুষ্ট।
প্রতিবন্ধকতা:
পুলিশ প্রশাসনের রাজনৈতিক ব্যবহার
দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের অভাব
মামলার তদন্তে দুর্বলতা
ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ
ইতিবাচক পদক্ষেপ:
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’-এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ১১,০০০+ অপরাধী গ্রেফতার
ঢাকা মেট্রোরেলে ‘MRT পুলিশ ইউনিট’ চালু
সামরিক বাহিনী যৌথভাবে কিছু এলাকায় টহল জোরদার করেছে
মানবাধিকার পরিস্থিতি
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশে বর্তমানে মানবাধিকার পরিস্থিতি গুরুতর। বিশেষ করে:
বিচারবহির্ভূত হত্যা
গুম
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া
রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়ন
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, "বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে এবং তা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।"
শেষ কথা (পর্ব ১)
বাংলাদেশের বর্তমান অপরাধ পরিস্থিতি একদিকে যেমন উদ্বেগজনক, অন্যদিকে তেমনি একটি বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি—যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতা মিলে অপরাধের জন্ম দেয়। তবে এর সমাধানও অসম্ভব নয়, যদি সরকার, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ একসঙ্গে কাজ করে।