যারা পবিত্র কোরআনের পাঠক, যারা কোরআনকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করতে চায়, তাদের জন্য এ বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি যে কোরআনের কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা করতে হলে প্রথমে যেতে হবে কোরআনের কাছেই, তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস, অতঃপর সাহাবি-তাবেয়িদের বক্তব্য।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া লিখেছেন, ‘তাফসিরের সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, তাফসিরুল কোরআন বিল কোরআন বা কোরআন দিয়ে কোরআনের ব্যাখ্যা করা। যে বিষয়টি কোরআনের এক জায়গায় অস্পষ্ট, অন্য জায়গায় তার বিশদ বিবরণ আছে; কোথাও সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলেও অন্যত্র সেটি ব্যাখ্যা করা হয়েছে বিস্তারিতভাবে। এই পদ্ধতিতে যদি সমাধান না হয়, তাহলে যেতে হবে হাদিসের কাছে।
কেননা হাদিস কোরআনের ব্যাখ্যা বলে দেয়, মর্ম নির্দিষ্ট করে দেয় এবং প্রায়োগিক জায়গা ঠিক করে দেয়। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) তো এ পর্যন্ত বলেছেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যে বিধান দিয়েছেন, তা কোরআন থেকেই দিয়েছেন।’ (উসুলে তাফসির, পৃ. ৯২)
কোরআনুল কারিমের আয়াতগুলো পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ। এক আয়াত অন্য আয়াতের সমর্থন করে; ব্যাখ্যা করে।
এ বিষয়টি শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.)-এর ভাষায় এভাবে এসেছে, ‘কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে অন্য আয়াতের মিল আছে; এক আয়াত অন্য আয়াতের সত্যায়নকারী। আর কোরআনের মূল ব্যাখ্যাকার বা মুফাসসির হলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। (ইজালাতুল খাফা, প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ)
এ জন্য কোরআনুল কারিমের প্রতিটি আয়াতের সে মর্ম গ্রহণ করা জরুরি, যে মর্ম অন্য আয়াত ও হাদিস সমর্থন করে। এটি একটি অকাট্য ও অলঙ্ঘনীয় নীতি।
একে যদি কেউ এড়িয়ে যেতে চায়, সে বিভ্রান্তির শিকার হবে; সত্য থেকে বিচ্যুত হবে।
বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার জন্য আমরা একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি, কোরআনুল কারিমে ইহুদিদের সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘আর তাদের ওপর আরোপ করে দেওয়া হলো লাঞ্ছনা ও মুখাপেক্ষিতা।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৬১)
অর্থাৎ তারা পৃথিবীতে সর্বদা লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হবে।
কিন্তু বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ইহুদিরা শক্তিশালী অবস্থানে আছে। তারা নিজস্ব দেশ গঠন করেছে।
অর্থবিত্ত, প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র ও বিজ্ঞানচর্চা ও আধুনিকতায় বিশ্বের বুকে গুরুত্বপূর্ণ আসনে সমাসীন আছে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে—পবিত্র কোরআনে ইহুদিদের সম্পর্কে যে লাঞ্ছনা ও অপদস্থের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল, তা কি সব যুগের জন্য প্রযোজ্য নয়?
এই প্রশ্ন মূলত তৈরি হয়েছে আয়াতটির ব্যাখ্যায় কোরআনের অন্য আয়াতের দিকে লক্ষ না করার কারণে। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘ওদের ওপর লাঞ্ছনা আরোপ করে দেওয়া হয়েছে, ওরা যেখানেই থাকুক; তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুকম্পা অথবা মানুষের আশ্রয় গ্রহণ করলে (ভিন্ন কথা)। আর ওরা আল্লাহর ক্রোধ নিয়ে ফিরেছে এবং ওদের ওপর আরোপ করে দেওয়া হয়েছে মুখাপেক্ষিতা। তা এ জন্য যে ওরা আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করে চলত এবং নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করত। তা এ জন্যও যে ওরা নাফরমানি করত এবং সীমা লঙ্ঘন করে থাকত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১১২)
স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, এ আয়াতে বলা হয়েছে ইহুদিদের লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার দুটি পথ আছে—
১. ইসলাম কবুল করে নেওয়া।
২. অন্য কারো আশ্রয় গ্রহণ ও অভিভাবকত্ব মেনে নেওয়া।
অর্থাৎ অন্যের সহায়তা ও আশ্রয় ছাড়া তারা দুনিয়াতে জাতীয়ভাবে সম্মান ও মর্যাদা কখনো অর্জন করতে পারবে না। আর এটা সবার জানা-ইহুদি রাষ্ট্রটির নিজস্ব কোনো ভিত্তি নেই। এর সবটুকু ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা ও তাদের দোসরগোষ্ঠীর অনুগ্রহ ও অনুকম্পার ফল!
মূল কথা হলো, সুরা আলে ইমরানের এই বিশ্লেষণের পর সুরা বাকারার ওই আয়াতের বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু যারাই সেদিকে লক্ষ করেনি, তারাই বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।
সুতরাং বোঝা গেল, পবিত্র কোরআনের এক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা করে। তাই কোরআনের তাফসির বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এই দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে।