রেললাইনে প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে, মিলছে লাশ। এর মধ্যে বেশির ভাগই আত্মহত্যা। এ ছাড়া রয়েছে অসচেতনতা বা অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। অপরাধীরাও হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে রেললাইনে লাশ ফেলে যায়। রেললাইনে পাওয়া লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মেলে না রিপোর্ট। পাওয়া যায় না পরিচয়। এর প্রধান কারণ- ট্রেনে কাটা পড়ে লাশ বিকৃত হয়ে যায়। ফলে জানা যায় না মৃত্যুর আসল কারণ। আবার কিছু ক্ষেত্রে রিপোর্ট পাওয়া গেলে দেখা যায়, লাশে রয়েছে অন্য রহস্য। মৃত্যুর ধরন দেখে দুর্ঘটনা মনে হলেও দেখা যায়- এ লাশ ছিনতাইকারীরা ফেলেছে অথবা হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে লাশ এনে রেললাইনে ফেলে দুর্ঘটনা হিসেবে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে।


গত ২৮ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদী রেলওয়ে স্টেশনের দক্ষিণে উমিরপুরের কাছে খুলনা-পার্বতীপুর রেললাইনের ওপরে বাদশা (৫৫) নামে এক ব্যবসায়ীর গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে ঈশ্বরদী রেলওয়ে থানা পুলিশ। তার বাড়ি ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়নের যুক্তিতলা কাদেরের মোড়ে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রাত সাড়ে ৮টার দিকে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে বাদশাকে তুলে নেয়। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে থানায় জিডি করে তার পরিবার। একপর্যায়ে জানতে পারে, বাদশার দ্বিখণ্ডিত লাশ রেললাইনে। মুদি দোকান আছে। কে বা কারা তার কাছে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না পেয়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে রেললাইনে রেখে যায়। একই দিন রাজধানীর বিমানবন্দরে কাওলা রেলগেট সংলগ্ন এলাকা থেকে অজ্ঞাত (৬৫) ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি হেঁটে হেঁটে ট্রেন লাইন পারাপারের সময় যমুনা এক্সপ্রেসগামী ট্রেনের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই মারা যান বলে জানায় বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ।


গত ২৭ এপ্রিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর উপজেলা পরিষদের কাছেই রেললাইনের পাশ থেকে ইকবাল হোসেন (৩০) নামে এক যুবকের খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে পুলিশ। এর এক দিন আগে, ২৬ এপ্রিল থেকে ইকবাল নিখোঁজ ছিলেন। তার বাড়ি কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নের বরচেগ গ্রামে। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২৫ এপ্রিল ইকবাল কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ভেড়াছড়া গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায়। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছে সেখান থেকে পরদিন বিকালে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। প্রথমে মোবাইলে কল গেলেও পরে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। ইকবালের সন্ধান চেয়ে ছবিসহ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে। কমলগঞ্জ থানায় জিডিও করা হয়। ইকবালের পরিবার এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলছে, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। ইকবালের স্ত্রী রিমা বলেন, আমাদের বিয়ের মাত্র ৬ মাস হয়েছে। এখন ৩ মাসের বাচ্চা আমার পেটে। আমার স্বামী ট্রেনের নিচে পড়ে নিহত হতে পারে না। এটা পরিকল্পিত হত্যা। আমি স্বামী হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই। রেলওয়ে পুলিশের বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, রেললাইনে পাওয়া লাশের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আত্মহত্যা। ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। আর ৩০ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে কানে মোবাইল ফোন বা হেডফোন লাগিয়ে অসচেতনভাবে চলাচলের কারণে। বাকি ১০ শতাংশ হত্যা ও অন্যান্য মৃত্যু। প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথের ৯৮ শতাংশ এলাকাই রাতে অন্ধকারে ঢাকা থাকে। অনেক এলাকা থাকে নির্জন। অপরাধীরা লাশ গুম করতে এসব অন্ধকার ও নির্জন এলাকা বেছে নেয়। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অপরাধ কমাতে হলে লাইন ঘেঁষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন এবং সচেতনতা জরুরি। রেলওয়ে পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে রেললাইন থেকে ২০২৪ সালে ১ হাজার ১৭টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সে হিসাবে রেললাইন থেকে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮৫টি লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৭৯৪ জন পুরুষ এবং ২২৩ জন নারী। এসব লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ৯৯৮টি অপমৃত্যুর মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত শেষে ৬টি মামলা খুনের মামলায় রূপান্তরিত হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে রেললাইন থেকে ১৬৮টি লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে রেললাইন থেকে ৫ হাজার ৩৬২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৮১ জন হত্যাকাণ্ডের শিকার বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।


ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, রেললাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না। এ জন্য দুর্বৃত্তরা কাউকে অচেতন করে রেললাইনে ফেলে রেখে হত্যা করতে পারে। আর পুলিশ ভিসেরা পরীক্ষার আবেদন না করায় নিহতদের ভিসেরা সংরক্ষণ করে অচেতনের বিষয়টিও পরীক্ষা করা হয় না। মৃত্যুর কারণ নিয়ে সন্দেহ হলে অনেক চিকিৎসক আবার ‘হত্যা’ ‘আত্মহত্যা’ কিংবা ‘দুর্ঘটনাজনিত’- এসব কিছুই উল্লেখ করেন না। রেল আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ অবস্থান করতে পারবে না। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভিতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেপ্তারের বিধানও রয়েছে। কিন্তু জনবহুল দেশ হিসেবে বাস্তব কারণেই এজন্য কাউকে আটকের উদাহরণ নেই।


রেলওয়ে পুলিশের ডিআইজি (এইচআরএম অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) শেখ মোহাম্মদ রেজাউল হায়দার জানান, রেলপথ ভ্রমণের একটি নিরাপদ মাধ্যম। এ পথে মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। নানা কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় দৈনিক গড়ে তিনজনের কাছাকাছি ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যায়। কখনো কখনো হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে নিতে দুষ্কৃতকারীরা লাশ এনে লাইনের ওপর ফেলছে। সারা দেশে ৩ হাজার ২০০ কি.মি.-এর ওপরে রেলপথ রয়েছে। পুরো রেলপথ পাহারা দেওয়া রেলওয়ে পুলিশের পক্ষে যৌক্তিকভাবে কখনো সম্ভব নয়। তা ছাড়া পুরো রেলপথই উন্মুক্ত, বেড়া কিংবা দেয়াল নেই। লাশের সুরতহাল দেখে সুস্পষ্টভাবে হোমিসাইড কেস প্রতীয়মান না হলে প্রাথমিকভাবে অপমৃত্যুর মামলা নেওয়া হচ্ছে, ফরেনসিক প্রতিবেদনের আলোকে পরবর্তীতে হত্যা মামলা রজ্জু করে পুলিশ হত্যা মামলা তদন্ত করছে। রেললাইনে হত্যা মামলা রহস্য উদঘাটনে রেলওয়ে পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করলেও ঘটনাস্থল নির্ধারণে জটিলতা, ভিসেরা রিপোর্ট প্রাপ্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা, সত্য উদঘাটনে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বসহ নানা কারণে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। হত্যার পর অনেক সময় লাশ বিকৃত করে ফেলা হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে আত্মীয়স্বজন বা পরিবারের সদস্যরা ভুক্তভোগীর অবস্থান খুঁজে পান না। তাদের অবস্থান হয় বেওয়ারিশ বা পরিচয়বিহীন লাশ হিসেবে। এ ছাড়া বিভিন্ন দুর্ঘটনার কারণে অনেক লাশের পরিচয় মিলছে না। তবে পুলিশ যদি ঘটনার বিবরণ বা লাশের কিছু ক্লু দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে সেই বিজ্ঞাপন দেখে নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা তৎপর হবে এবং লাশ খুঁজে পেতে পারে।